কাঠ মিস্ত্রী পদে চাকরি করেও দীর্ঘ ১৬বছর কারাভোগ করেন নারায়ণ

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ || ২০২৫-০১-২৮ ১৫:৪০:৫৯

image

তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর(বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) অসামরিকে কার্পেন্টার(কাঠ মিস্ত্রি) পদে কাজ করতো নারায়ণ কুমার দাস(৬৩)। ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলার আসামী হন নারায়ণ। সেই মামলায় তারও সাজা হয়। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর কারাভোগের পর নারায়ণ কুমার দাস বাড়ীতে ফিরেছেন।

 গত ২৩শে জানুয়ারী গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি রাতে রাজবাড়ীতে ফেরেন। তাকে আনতে গিয়েছিলো তার একমাত্র ছেলে আনন্দ কুমার দাস। দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাবাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় মা হারা ছেলে আনন্দ কুমার।

 নারায়ণ কুমার দাস দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালী থানার কাঠাপাড়া গ্রামের মৃত কৃষ্ণ গোপাল দাসের ছেলে। নারায়ণের শশুর বাড়ী রাজবাড়ী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের লক্ষীকোল গ্রামে। তার গ্রামের বাড়ী দিনাজপুর জেলা হলেও তিনি রাজবাড়ীতে তার শশুর বাড়ীতে বসবাস করতো।

 জানা গেছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে নারায়ণ কুমার দাস ছিলেন ছোট। বাবা করতেন কৃষি কাজ। নারায়ণের বয়স যখন তিন/চার বছর তখন তার বাবা কৃষ্ণ গোপাল দাস মারা যান। পরে ১৯৭৬ সালে রাজবাড়ী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের নিলু রানী পালের সাথে নারায়ণ কুমার দাসের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই নারায়ণ পরিবার নিয়ে রাজবাড়ীতে ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ(বিডিআর) এ কার্পেন্টার (কাঠমিস্ত্রী) পদে যোগদান করেন তিনি। চাকুরি করেই সংসার চালাতেন নারায়ণ দাস। ২০০৯ সালে পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহে তাকে জেলে যেতে হয়। নারায়ণের স্ত্রী নিলু রানী পাল (৫৫) ২০২১ সালে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নারায়ণের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।

 নারায়ণ কুমার দাস বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ শে ফেব্রুয়ারীতে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাতে আমরা পিলখানাতেই ছিলাম। আমি সদর দপ্তরে নির্মাণ শাখায় কার্পেন্টার (কাঠ মিস্ত্রি) পদে চাকরি করতাম। পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের দিন আমরা যারা সিভিল এমপ্লয়ি ছিলাম তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। পরবর্তীতে পিলখানায় যোগদানের জন্য আমাদের ডাকা হয়। আমরা যোগদান করতে পিলখানার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরে পিলখানায় যাওয়ার পর আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তারা আমাদের আবাহনীর মাঠে থাকতে বলে এবং তারা জানায় অনুমতি পেলেই আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমাদের অনেক মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিলো। সামান্য খিচুরি দিত, সেটা তিন চারজন মিলে খেতাম। এরপর র‌্যাব জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের নিয়ে গেলো। সবাই বললো আমরা নিরপরাধ, আমাদের কোন হাতিয়ার নেই। তারা বলল কি জানো সেটা বলো। আমরা বললাম কিছুই জানিনা। কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে যেখানে ঘটনা ঘটেছিল সেটা প্রায় আধা মাইল দূর। জিজ্ঞাসাবাদের পরে আমাদের জেলে পাঠিয়ে দিল। আমার এটুকুই অপরাধ পিলখানার গন্ডগোলের দিন কেন আমি ওখানে ছিলাম। এরপর থেকেই আমার জেল জীবন শুরু। তারা আমাদেরকে শান্তনা দিয়ে বলেছিল যে আমাদের সাধারণ ক্ষমা করেছে সরকার, শুধু নিরাপত্তার জন্য কয়েকদিন জেলে থাকতে হবে। কিন্তু বিগত ১৭ বছর আমাকে জেলে থাকতো হলো। অনেক মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।

 তিনি বলেন, জেলে পাঠানোর পর আমরা যতটুকু জানতে পারি আমাদের হত্যা মামলা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আমাদেরকে বিস্ফোরক মামলা দেওয়া হয়, যেটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে আমি হত্যা মামলায় খালাস পাই। খালাস পাবার পরও ২০১৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল এই ১২ টি বছর আমি শুধু শুধু জেল খাটলাম। হত্যা মামলায় যখন সরকার আমাকে ক্ষমা করে দিলো তখন বিস্ফোরক মামলায় আমাকে কিভাবে জেলে রাখল এটা আমার বোধগম্য নয়। কারণ হত্যা মামলা না থাকলে তো অন্য মামলা থাকার কথা না। কি কারণে সরকার ১২ বছর বিনা কারণে আমাকে জেল খাটাল সেটা আমি জানিনা।

 তিনি বলেন, জেলে থাকা অবস্থায় আমার মেয়ের বিয়ে হয় আমি দেখতে পারি নাই। আমার স্ত্রী ২০২১ সালের মার্চ মাসে ক্যান্সার হয়ে মারা যায় আমি দেখতে পারি নাই। এটা আমার জন্য আরও বেদনাদায়ক ছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি বাসায় আসলেও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার নিজের বলতে আমার শশুর বাড়ীর লোকজনই সবকিছু। দিনাজপুর আমার বাড়ী হলেও সেখানে স্থাবর অস্থাবর কিছুই নেই আমার। জানিনা সামনে ভাগ্যে কি আছে। তবে আমার অনুরোধ থাকবে সমন্বয়ক বা ছাত্ররা যারা আমাদের জন্য এতকিছু করেছে তারা যেনো আমাদের দিকে একটি নজর দেয়।

 নারায়ণ দাস বলেন, জেলের মধ্যে সবথেকে বেশি ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে। জেল থেকে আমাকে জানানো হয় আমার স্ত্রী মারা গেছে। পরে আমার ছেলে ও মেয়ে আমার সাথে দেখা করে। আমি খুব মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমাকে দান্ডাবেড়ি লাগিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হতো। এটা আমার কাছে অনেক কষ্টের ছিল, যেটা স্মৃতি হয়ে থাকবে। ২০১৬/১৭ সালে এসে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম মুক্তি পাবোনা, ছেলে ও মেয়েদের সাথে আর দেখা হবে না, জেলেই মৃত্যু হবে। কারণ আমাদের জন্য কথা বলার মতন কেউ ছিল না। জেলের মধ্যে অনেক বিডিআর সদস্য মারা গেছে দেখেছি। ভগবানের অসীমকৃপা ও ছাত্র সমাজের কৃতিত্ব ভোলার মতন নয়। ওদের জন্যই আমি আমার সন্তানদের কাছে ফিরে আসতে পেরেছি।

 তিনি বলেন, আমি টাকা পয়সা জমা করে রেখে যেতে পারি নাই। আমার বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে এটা এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শশুর বাড়ীতে  আমার স্ত্রীর ভাইদের থেকে নিয়ে একদিন/দুইদিন চলতে পারি। কিন্তু তিন/চার মাস তো চলতে পারি না। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারপরও আশা আছে একটি ভালো দিকনির্দেশনা আমাদের জন্য আসবে। এই আশায় আমি বেঁচে আছি।

 নারায়ণ কুমার দাস বর্তমান সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে বলেন, সরকারের কাছে দাবী একটাই আমাদের চাকরি ফেরত দিবে অথবা আমার চাকুরি জীবনের সকল বেতন, রেষন সকল কিছু ফেরত দিতে হবে, তা না হলে চলবো কিভাবে। আমিতো সরকারের জন্য সাড়ে ২৩ বছর চাকরি করেছি। আমার অপরাধটা কি আমি আজও খুঁজে পাইনি। আমি কি জন্য ১৬/১৭ বছর জেল খাটলাম এটা আজও আমার মাথায় ঢুকেনা। আমি সিভিল এমপ্লয়ি হয়েও ফ্যাস্টিট সরকার আমাকে ১৬/১৭ বছর জেল খাটালো।

 জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান নিহত ও শহীদদের উদ্দেশ্য নারায়ণ বলেন, আমাদের একটা ইচ্ছা ছিল জেল থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার কবর জিয়ারত করা কিন্তু সেটা হয়ে উঠে নাই। আমরা যারা মুক্ত হয়েছি তাদের আবার ১০ তারিখে ডেকেছে। তখন আমরা আমাদের স্যারদের কবর জিয়ারত ও জুলাই আগস্টে যে সকল ছাত্ররা শহীদ হয়েছেন তাদের কবর জিয়ারত করবো। কারণ তাদের জন্যই আমি আমার ছেলেমেয়েদের মুখ দেখতে পাচ্ছি। এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। আমরা জেলে থেকে শুনেছি ৫ই আগস্টের ঘটনা। আমরা তো দেখতে পারি নাই তাদের। তাদের এই ঋণ তো আমরা শোধ করতে পারবো না। তাদের কবর জিয়ারত করতেই হবে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। তাদের জন্যই আমরা আজ মুক্ত জীবনে আসতে পেরেছি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তাদের সব অপরাধ যেনো ক্ষমা করে দেয়। কারণ তারা আমাদের জন্যই লড়েছে। আমাদের মুক্তির জন্য তারা অনেক চেষ্টা করেছে। তাজা রক্তের বিনিময়ে আজকে আমরা জেল থেকে মুক্ত হতে পেরেছি।

 নারায়ণ কুমার দাসের ছেলে আনন্দ কুমার দাস(৩৩) বলেন, আমি যখন ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন আমার বাবা জেলে চলে যায়। ২০১০ সালে আমার রেজাল্ট হয়, আমি পাশ করি। কিন্তু টাকার অভাবে আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই। পরবর্তীতে নিজের মামার দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করি। এভাবেই সময় চলে যাচ্ছিল। ৪/৫ বছর আগে আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাবা জেলে, মা মারা গেলো, সন্তানের জীবনে যদি অভিভাবক না থাকে তাহলে তার জীবনে আর কিছু থাকেনা, যেটা আমি বুঝেছি। মা মারা যাবার পর বাসা ভাড়া থাকতাম। সেখানে একা কিভাবে থাকবো সেটা ভেবে মামারা আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসলো। আমার মামারা যদি না থাকতো এই ১৬ টি বছর কিভাবে যেতো আমি জানতাম না, কারণ আমার বাবা তো জেলে তার একটা ঠিকানা ছিল, কিন্তু আমার মামারা না থাকলে আমাদের কি হতে আমি জানিনা।

 তিনি বলেন, ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অবদানের কারণে আমার বাবাকে আজ ফিরে পেয়েছি। এতে আমি খুব খুশি। ১৬ বছরের দুঃখ কষ্টের দায়দায়িত্ব টা কে নেবে। এখন আমি বাবাকে পেলেও মায়ের অভাবটা ভুলতে পারছি না। একজন আসছে একজন নেই। এই অভাব কি পূরণ হবে কখনো।

 ১৬ বছর পর বাবাকে পাবার অনুভূতিটা অন্যরকম। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু এই ১৬ বছরের এই মিসিং টা এই জিনিসটার অভাব ভুলতে পারি না। ১৬ বছর বাবা ছিলো না, এখন বাবা এসেছে এর অনুভূতিটা অন্য রকম। খুব ভালো লাগছে বাবাকে পেয়ে। কিন্তু ওই ১৬ বছরটা ধরে পাইতাম তাহলে জীবনটা আরও ভালোভাবে সাজাতে পারতাম। আমার জীবন, বাবার জীবন, মা টাও হয়তোবা অকালে মারা যেতো না। সরকারের কাছে আমার দাবী দাওয়া, আমার বাবা ১৬ বছর যে বিনা অপরাধে কারাভোগ করলো, সে এখন মুক্ত হয়েছে। তার এখন যে অবস্থা পরিশ্রম করার মতন সেই বয়সটা তার আর নেই। সে জেলে যাওয়ার আগে কিছু করেও যেতে পারে নাই। সরকারের কাছে আবেদন আমার বাবার চাকরিটা যেনো ফেরত পায়। অথবা ১৬ বছরের তার যাবতীয় ক্ষতিপূরণ গুলো দেয়, তাহলে সামনের দিনগুলো আমি ও বাবা কোন রকম বেঁচে চলে যেতে পারতাম।

 নারায়ণ কুমার দাসের শ্যালিকা রিতা রানী পাল বলেন,  দীর্ঘ ১৬ বছর আমার জামাইবাবু জেলে ছিল। এর মধ্যে আমার দিদি অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিদির ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়। অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে সুস্থ করার জন্য। কিন্তু আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। অকালে আমার দিদিকে চলে যেতে হয়েছে। আমার ভাগ্নে ও ভাগ্নিকে আমার ভাইয়েরাই আশ্রয় দিয়েছে। আমার ভাগ্নিকে দেখে শুনে আমার ভাইয়েরাই তাকে বিয়ে দেয়। শেষ মুহূর্তে আমার ভাগ্নেরা তাদের বাবাকে ফিরে পেয়েছে। এতদিন পরে দুইটা ভাই-বোন তার বাবাকে ফিরে পেয়েছে আমাদের খুব ভালো লাগছে। আমরা আমাদের বোনটাকে হারিয়েছি। দীর্ঘদিন পড়ে জামাই বাবুকে আবার ফিরে পেয়েছি এটাই আমাদের শান্তনা।

ঢাকা অফিস : ৩৪/১ ডি-২, হাটখোলা সড়ক (অভিসার সিনেমা হলের পিছনে), ঢাকা-১২০৩। ফোন অফিস : 0641-66666, বার্তা বিভাগ : 66333, রাজবাড়ী প্রেসক্লাব অফিস : 66660, বাসা : 65728, মোবাইল : 01713-489472, 01715-019375, 01715-621243, ই-মেইল : motin_rajbari@yahoo.com এবং matrikantha@gmail.com