ঢাকা সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংক শাখায় জাল কাগজে ভুয়া ঋণ॥শতাধিক কৃষককে লাল নোটিশে হয়রানী
  • মীর সামসুজ্জামান সৌরভ
  • ২০২২-০৭-৩০ ১৪:৫৫:৪৩
কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে কোন ঋণ না নিয়েও রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে শতাধিক কৃষক পেয়েছে ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ। হঠাৎ করেই ঋণ খেলাপীর এমন নোটিশ পেয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে তারা -মাতৃকণ্ঠ।

কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে কোন ঋণ না নিয়েও শতাধিক কৃষক পেয়েছে ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ। হঠাৎ করেই ঋণ খেলাপীর এমন নোটিশ পেয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। ঘটনাটি ঘটেছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।
  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার দালাল হিসেবে পরিচিত একটি প্রতারক চক্র ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং ওই সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের যোগসাজশে ২০১৫ সাল এবং পরবর্তী সময়ে নিরীহ সাধারণ কৃষকের নামে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে টাকা তুলে নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। যাদের নামে ঋণ তোলা হয়েছে তারা কখনো ঋনের জন্য আবেদন করেনি এবং ব্যাংকেও আসেনি। 
  অভিযোগ উঠেছে, কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠকর্মী রেজাউলের সাথে একটি প্রতারক চক্র সমন্বয় করে কিছু কৃষকদের নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাল ওয়ারিশ সনদ তুলে কৃষকদের নামে ঋণ উঠিয়ে নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করে নেই। অথচ যাদের ঋণ পাওয়ার কথা তারা ঋণের টাকা পায়নি। আবার জায়গা-জমি নেই এমন অনেকে ঋণ পেয়েছেন। এ ঘটনার দীর্ঘ ৭বছর পর গ্রহীতাদের ঋণ খেলাপির নোটিশ দেওয়া হয়েছে কৃষি ব্যাংক থেকে।
  বিষয়টি খোঁজ নিতে এ প্রতিবেদক যায় ঋণ খেলাপীর নোটিশ পাওয়া রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মন্ডল বাড়ীতে। মন্ডল বাড়ীর ছেলে ইউসুফ মন্ডল, ছলিম মন্ডল ও আজিম মন্ডল। তারা আপন তিন ভাই। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা ব্যাংক থেকে কখনো কোন ঋণ গ্রহণ করেনি। অথচ মাস ছয়েক আগে তিন ভাইয়ের নামেই আসে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা থেকে ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ। সেখানে বলা হয়েছে তারা ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণ নেওয়ার পর থেকেই তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। যা সুদ-আসলে এখন তা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ কখনো ঋণের জন্য আবেদনতে দূরের কথা ব্যাংক অব্দিও জাননি তারা। ফলে ব্যাংক থেকে বাড়িতে আসা ঋণ খেলাপীর চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবারটির সদস্যরা।
  শুধু এ তিন ভাই নন খানগঞ্জ ইউপির গোবিন্দপুর এলাকার বারেক শেখ, লতিফ শেখ, রহিমসহ অনেক কৃষকই পেয়েছেন কৃষি ব্যাংকের ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ।
  ভুক্তভোগীরা বলেন, কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখায় কর্মরত তৎকালীন মাঠ কর্মী রেজাউলসহ তাদের গ্রামের কয়েকজন প্রতারক চক্র জালিয়াতি করে স্থানীয় কৃষকদের নামে ঋণ তুলে তাদের ফাঁসিয়েছেন।
  এ ব্যাপারে কথা হয় ঋণ খেলাপীর নোটিশ পাওয়া ভুক্তভোগী তিন ভাই আজম মন্ডল, ইউসুফ মন্ডল ও সলিম মন্ডলের সাথে। তারা বলেন, কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এই পর্যন্ত কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ করেই মাস ছয়েক আগে কৃষি ব্যাংকের রাজবাড়ী শাখা থেকে কয়েকজন এসে আমাদের তিন ভাইকে তিনটি ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ দিয়ে যায়। আর তাতে লেখা আমরা ২০১৫ সালে ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেই। যা ৭ বছর পর সুদে আসলে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা হয়েছে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে এ টাকা পরিশোধ না করলে গ্রেফতারী পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরে আমরা তিন ভাই ব্যাংকে গিয়ে বিষয়টি ম্যানেজারের সাথো আলাপ করি এবং নথি খুঁজে দেখি ঋণের জন্য তাদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে অন্য মানুষের। আবার ব্যাংকে যে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেয়া হয়েছে সেটিতে তাদের নাম-ঠিকানা থাকলেও এ তিন ভাইয়ের আসল জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আর জন্ম তারিখের সঙ্গে নেই কোন মিল। পরে বিষয়টি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবগত করলে তারা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৬/৭ মাস পার হলেও বিষয়টির সুরহা না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
  ঋণ খেলাপীর নোটিশ পাওয়া আরেক ভুক্তভোগী বারেক শেখ বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে তাই কৃষিকাজ অনেক আগেই বাদ দিছি। এহন ছেলে কৃষি কাজ করে। আমরা বাপ-বেটা কখনো ব্যাংক থেকে ঋন করি নাই। আর রাজবাড়ী কোথায় কৃষি ব্যাংক, সেটিও আমি জানি না। কখনো ব্যাংকে যাইনি। অথচ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, আমার ছেলের কাছে ব্যাংক ১লক্ষ ১৫ হাজার টাকা পায়।’
  বারেক শেখের ছেলে লতিফ শেখ বলেন, লাল নোটিশ পাবার পর বিষয়টি খোঁজ নিতে আমরা ব্যাংকে যায়। পরে দেখি আমাদের নাম করে ঋণ নিয়েছে সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মনছের শেখের ছেলে মোঃ শাহিন খান। তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠ কর্মী রেজাউলের মাধ্যমেই এমন প্রতারণা করে তারা টাকা তুলেছে।
  এ ব্যাপারে শাহিন খানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
  তবে বেলগাছি রেলস্টেশন এলাকায় এসে মিরাজ নামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার বাড়িও সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নে। তিনি বলেন, আমার বাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোন জমি নেই। ২০১৫ সালের দিকে বেলগাছী বাজারে কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন মাঠ কর্মী রেজাউল হকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন রেজাউল কথায় কথায় বলে আপনাকে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিবো। তবে এর মধ্যে থেকে আমাকেও ভাগ দিতে হবে। পরে রেজাউল নিজেই জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংক থেকে আমার নামে ৮০ হাজার টাকা ঋণ তোলেন। পরে রেজাউল হক ৫০ হাজার টাকা রেখে আমাকে ৩০ হাজার টাকা দেন। এরপর কিছুদিন রেজাউল আমার কাছে ফোনে ঋণের টাকা চান। আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়েছি ব্যাংকে টাকা দেব। আপনার কাছে দেব না।
  তিনি আরও বলেন, আমি ব্যাংকের কোনো নোটিশও পাইনি, টাকাও দেইনি। আমাদের এলাকায় কৃষি ব্যাংকে থেকে এমন ঋণ রেজাউল হকই করে দিয়েছে, সেখান থেকে টাকার একটি অংশ তিনিই নিয়েছেন।
  অভিযুক্ত রেজাউল হক বর্তমানে কৃষি ব্যাংক শরীয়তপুর আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত। তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার মোবাইলে একাধিকবার কল কল করা হলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।এই জন্য তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
  এ ব্যাপারে খানগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আতাহার হোসেন তকদির বলেন, আমি দীর্ঘ ১১ বছর এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীনও গোবিন্দপুর ও হরিহরপুর এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ পায়। পরে তারা আমার কাছে এসে বলে তারা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণের জন্য আবেদনও করেনি। পরে আমি তাদেরকে সাথে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে দেখি আমার সই, ইউনিয়নের প্যাড জাল করে ভূয়া ওয়ারিশ নামা বানিয়ে ঋণ তোলা হয়েছে।
  তিনি আরও বলেন, এ রকম শতাধিক কৃষকের নামে ঋণ খেলাপীর নোটিশ এসেছে। স্থানীয় কিছু প্রতারক চক্র ও তৎকালীন কৃষি ব্যাংকের মাঠ কর্মী রেজাউল প্রকৃত কৃষিকদের নামে টাকা তুলে তারা নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করে নেই। এ ধরণের প্রতারক চক্রের জন্য প্রকৃত কৃষকরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি এ ধরনের প্রতারক চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
  একটি সূত্র জানায়, কৃষি ঋণ বিতরণে ঘুষ বাণিজ্যসহ দালাল ও প্রতারক চক্রের সহযোগিতায় ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা গত ১০ বছরে কৃষি ব্যাংকের রাজবাড়ী শাখাসহ রাজবাড়ী অঞ্চলের বিভিন্ন শাখায় নিরীহ কৃষকের নামে জাল কাগজপত্রে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে সংশ্লিষ্টরা বহু টাকা আত্মসাত করেছে। দুর্নীতিবাজ অসাধু কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে রাজবাড়ী অঞ্চল ছাড়লেও ঋণ না নিয়ে ঋণ খেলাপীর লাল নোটিশ পাওয়া নিরীহ কৃষকেরা পড়েছে মহাবিপদে।   
  কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ মোতাহার হোসেন বলেন, এ ঋণগুলো ২০১৫ সালে বিতরণ করা। আর আমি রাজবাড়ীতে যোগদান করেছি ৫ মাস আগে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে রেজাউল হক তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। সে এখন শরিয়তপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত। তবে এই ঋণ খেলাপীর বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। ঋনের কাগজপত্র তাদের কাছেই আছে। তাই আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
  এ বিষয়ে শরীয়তপুর কৃষি ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক(এজিএম) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংক শাখায় ঋণ প্রদানের অনিয়মের অভিযোগে রেজাউল হকের বিরুদ্ধে গত ২৭শে জুলাই নোটিশ পাবার পর তাকে ঐদিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমানিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজবাড়ীতে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসে বর্ণাঢ্য র‌্যালী ও আলোচনা সভা
রাজবাড়ী সফরে নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রাজস্ব সম্মেলনসহ কয়েকটি সভা
সর্বশেষ সংবাদ